Wednesday, February 21, 2018

জীবনস্মৃতি - রবি ঠাকুর

                                                                                                         জীবনস্মৃতি                                                 
                                                                                                                                  রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর

“জীবনস্মৃতি” প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে এই গ্রন্থ প্রকাশকালে রবীন্দ্রনাথের জীবনের পঞ্চাশ বছরের মত দীর্ঘ সময় পার করেছেন।   এখানে বাল্যকাল থেকে পঁচিশ বছর পর্যন্তকালের কাহিনী ও ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।  প্রচলিত কালানুক্রমিক বিবরনের পরিবর্তে ছোট ছোট ঘটনা, চিত্র, চরিত্রের সাহায্যে কবির স্বভাবের বিকাশ , অভিজ্ঞতা সঞ্চয় , জীবন বোধের পরিণতির বর্ণনা সহজ এবং সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। কৌতুক ও কবিত্বে গাঁথা বর্ণনা ভঙ্গিতে এটি বাংলা সাহিত্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী  জীবনী। আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এক নতুন ধারার সুচনা করেন এই গ্রন্থের মাধ্যমে।  


 পুস্তক পরিচিতিঃ
বইয়ের নামঃ জীবন স্মৃতি
লেখকঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বইয়ের ধরনঃ স্মৃতিচারণামূলক
প্রথম বিশ্বসাহিত্য সংস্করনঃ  মাঘ ১৪১৬, জানুয়ারি ২০১০
সর্বশেষ বিশ্ব সাহিত্য সংস্করনঃ বৈশাখ ১৪২২ , মে ২০১৫
গ্রন্থমালা সম্পাদকঃ আব্দুল্লাহ আবু সাইদ
প্রকাশকঃ মোঃ আলাউদ্দিন সরকার, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ১৭ ময়মনসিংহ রোড, বাংলামটর, ঢাকা ১০০০।
মুদ্রণঃ গ্র্যাফস ম্যান রিপ্রোডাকশন এন্ড প্রিন্টিং, ৫৫/১ পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
মুল্যঃ এক শত আশি টাকা মাত্র।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশনা ২৭৫,
উল্লেখ্য যে, “জীবন স্মৃতি” প্রথম ধারাবাহিকভাবে সাময়িকপত্র “প্রবাসী” তে ১৩১৮ থেকে ১৩১৯ বঙ্গাব্দে প্রকাসিত হয়। গ্রন্থ হিসেবে এটি প্রকাশিত হয় ১৩১৯ বঙ্গাব্দে(১৯১২)

লেখক পরিচিতিঃ   রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর   

জন্ম ৭ই মে, ১৮৬১ , বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ সালে কলকাতার  জোড়াসাঁকোর এক বিখ্যাত ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত এক তথ্যমতে   ঠাকুর পরিবারের আদিনিবাস ছিল বাংলাদেশের খুলনা জেলার রূপসা উপজেলা পিঠাভোগে বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭১৯০৫) এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী (১৮২৬১৮৭৫)তিনি ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়।  রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প[  ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছগীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।  রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে “গীতাঞ্জলিকাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ  ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। আলবার্ট আইনস্টাইন, ডাব্লিওবি ওয়েটস, টি এস এলিওট, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পসহ অনেক বিখ্যাত লোকজনের সাথে তাঁর হয়। “ আজ সবার রঙ্গে রঙ মেশাতে হবে” তাঁর এই গান তিনি নিজ জীবনে প্রয়োগের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর "অভিলাষ" কবিতাটি প্রকাশিত হয়।  এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়।[  ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট(বাংলা ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮) দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।


লেখার কারণঃ
ঘটনাক্রমে কোন একদিন জীবনের ঘটনা বলতে গিয়ে লেখক জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে আগ্রহি হয়ে পড়েন। তারই পরিনাম এই গ্রন্থ।
মূল আলোচনাঃ
লেখক জীবন স্মৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন যে, জীবনের ইতিহাস নয়-এটা অনেকটা চিত্রকর্মের মত। মস্তিষ্ক যেরকম কোন স্মৃতি মনে রাখবে কেউ বলতে পারে না, রবীন্দ্রনাথও তেমনি তাঁর এই গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে কোন প্রচলিত পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। চিত্রশালায় চলতে গিয়ে যখন যে স্মৃতির ছবির উপরে চোখ পরেছে সেই নিয়েই আলোচনা বা আলোকপাত করেছেন। বইটি পড়তে পড়তে এক এক সময় মনে হতে থাকে যেন আমরা লেখকের সাথে চলছি।   


বিষয়বস্তু ঃ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরের বিভিন্ন ঘটনা, ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। চুয়াল্লিশটি ছোট ছোট ভাগের মধ্য দিয়ে তিনি শৈশব থেকে যৌবনের কথা, গল্প, মানুষের সান্নিধ্যের কথা এখানে উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি কোন ক্রম অনুসরণ করেননি।  ভাগগুলো-
শিক্ষারম্ভ, ঘর ও বাহির, ভৃত্য রাজকতন্ত্র, কবিতা-রচনারম্ভ, নানা বিদ্যার আয়োজন, বাহিরে যাত্রা, কাব্যরচনাচর্চা,শ্রী কন্ঠবাবু, বাংলাশিক্ষার অবসান,পিতৃদেব, হিমালয়যাত্রা, প্রত্যাবর্তন, ঘরের পড়া,বাড়ির আবহাওয়া, অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী, গীতচর্চা, সাহিত্যের সঙ্গী, রচনাপ্রকাশ, ভানু সিংহের কবিতা, স্বাদেশিকতা,ভারতী, আমেদাবাদ,বিলাত,লোকেন পালিত, ভগ্ন হৃদয়, বিলাতি সংগীত,বাল্মিকীপ্রতিভা,সন্ধ্যাসংগীত,গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ, গঙ্গাতীর, প্রিয় বাবু, প্রভাতসংগীতরাজেন্দ্রলাল মিত্র,কারোয়ার, প্রকৃতির প্রতিশোধ, ছবি ও গান, বালক,বঙ্কিমচন্দ্র,জাহাজের খোল,মৃত্যুশোক,বর্ষা ও শরৎ, শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী ,কড়ি ও কোমল রবীন্দ্রনাথের জন্ম যদিও এক বিখ্যাত পরিবারে হয়েছিল তবু তাঁর শৈশব ছিল বিলাসিতা বর্জিতআমাদের শিশুকালে ভোগবিলাসের আয়োজন ছিল না বললেই হয়” খাবারের ক্ষেত্রে, কাপরচোপড় ক্ষেত্রে সৌখিনতা ছিলনা। ‘নেয়ামত খলিফা’ র জামায় পকেট না লাগিয়ে দেয়াটাই লেখকের একটা বড় দুঃখের কারণ ছিল।  রবীন্দ্রনাথ এর  শিক্ষা জীবনের শুরু অনেক ছোটবেলায় গৃহেই।  তাঁর চেয়ে বয়সে একটু বড় ভাই এবং ভাগিনেয়কে স্কুলে যেতে দেখে অনেক কান্নাকাটির পর তাঁকে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি করানো হয়। স্কুলের প্রতি তাঁর এ অতিরিক্ত আগ্রহে বিরক্ত হয়ে এক শিক্ষক চড় মেরে বলেছিলেন,”এখন ইস্কুলে  যাবার জন্য যেমন কাঁদিতেছ ,না যাবার জন্য ইহার চেয়ে অনেক বেশি কাঁদিতে হইবে” রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , “ এতবড়ো অব্যর্থ ভবিষ্যদ্‌বাণী জীবনে আর- কোনোদিন কর্ণগোচর হয় নাই”
   ,
ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে থাকাকালীনই তাঁর স্কুলের শিক্ষার প্রতি বিরক্তি চলে আসে। তিনি অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, “শিক্ষকের প্রদত্ত বিদ্যাটুকু শিখিতে শিশুরা অনেক বিলম্ব করে, কিন্তু শিক্ষকের ভাবখানা শিখিয়া লইতে তাহাদিগকে কোন দুঃখ পাইতে হয় না। শিক্ষাদান ব্যাপারের মধ্যে যে- সমস্ত অবিচার, অধৈর্য, ক্রোধ, পক্ষপাতপরতা ছিল, অন্যান্য শিক্ষনীয় বিষয়ের চেয়ে সেতা অতি সহজেই আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলাম” এরপর তিনি  নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করেস পড়াশোনা করেছিলেন শিক্ষাদের নিষ্ঠুর আচরণে  বিরক্ত হয়ে কোন কোন শিক্ষকের প্রশ্নেরও উত্তর দিতেন না। স্কুলের শিক্ষার অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। গৃহে গুরুমহাশয় পড়াত।
 জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ছোটদের দেখাশোনার ভার ছিল বাড়ির চাকরদের উপর। রবীন্দ্রনাথ এটাকে “ভৃত্যরাজতন্ত্র” বলে উল্লেখ করেছেন। বাড়ির বড়রা ছোটদের প্রতি নজর দেয়ার সময় ছিল না। “আদর করা ব্যাপারটা অভিভাবকদেরই বিনোদনের জন্য, ছেলেদের পক্ষে এমন বালাই আর নাই”ভৃত্যমহলেই দিন কাটত তাদের। এরাই ছিল শাসনকর্তা। “আমাদের এই শিশুকালের শাসনকর্তাদের মধ্যে অনেকেরই স্মৃতি কেবল কিল চড় আকারেই মনে আছে- তাহার বেশি আর মনে পড়ে না” ছোট বেলায় রবীন্দ্রনাথ বাড়ির বাইরে যাওয়ার সুযোগ খুব একটা পেতেন না। শ্যাম নামের এক ভৃত্য তাঁর চারিদিকে খড়ি দিয়ে গন্দি এঁকে বলত সেটার বাইরে গেলেই বিপদ। ছোটবেলার এ বন্দি দশা  তাঁকে বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে বেশি আগ্রহী করে তোলে। পরবর্তী জীবনে  তিনি যে বহু দেশ ঘুরেছেন, কত মানুষের সাথে মিশেছেন তার পিছনেও এটা একটা কারণ। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি তাঁর মধ্যে থেকেই গেছে।
“সেই খড়ির গণ্ডি মুছিয়া গেছে,
কিন্তু গন্ডি তবু ঘোঁচে নাই”

কবিতা রচনারম্ভঃ
জল পড়ে পাতা নড়েকে তিনি তাঁর জীবনের আদি কবিতা হিসেবে উল্লেখ করেসেন। কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন এটা তিনি প্রথম বুঝতে পারেন। লেখকের যখন বয়স সাত-আট না তাঁর এক ভাগিনা পয়ার ছন্দে চৌদ্দ অক্ষর যোগাযোগের রীতি পদ্ধতি শেখায়। বাড়ির কর্মচারীর কাছ একটা নীল কাগজের খাতা জোগাড় করে পেন্সিল দিয়ে লেখা শুরু করেন। যখন যাকে সামনে পাওয়া যেত তাকেই কবিতা শুনিয়ে দিতেন। “হরিণ শিশুনতুন শিং বাহির হইবার সময় সে যেমন যেখানে-সেখানে গুঁতা মারিয়া বেড়ায়’ তিনি অনেকটা সেরকম করতেন।



নানা বিদ্যার আয়োজনঃ


         স্কুলের পাশাপাশি বাড়িতেও পড়াশুনা ব্যাপকভাবে করতে হত। চারুপাঠ, বস্তুবিচার, প্রাণি বৃত্তান্ত, পদার্থবিদ্যা, ইংরেজি, জ্যামিতি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোলসহ আরো নানা বিষয়ে পড়তে হত। এছাড়াও কুস্তি, ড্রয়িং, জিমন্যাস্টিক চর্চাও করতে হত। বাংলা সাহিত্য চর্চা,  সংস্কৃতের চর্চা ও করা হত।  ঠাকুরবাড়িতে দিনরাত সাহিত্যের হাওয়া বইত। নাট্যচর্চা, বিভিন্ন ধরনের সাংগঠিক কাজের চর্চা হত। এসব কিছুই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে জাতীয়তার আদর্শ  জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে  
“জীবনস্মৃতি” তে লেখক কিছু মানুষের কথা  উল্লেখ করেছেন- শ্রীকণ্ঠবাবু, অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী, লোকেন পালিত,প্রিয়বাবু, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র, শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী, বিদ্যাসাগর। পিতা দেবেন্দ্রনাথ বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রায় অপরিচিত ছিলেন কারন তিনি দেশভ্রমনেই ব্যস্ত থাকতেন। এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন।
 প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন  করেন। শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই (ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায়। এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন।দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জীবনী, কালিদাস রচিত ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য নাটক এবং উপনিষদ্‌ পাঠেও উৎসাহিত করতেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “যেখানে তিনি ছুটি দিতেন সেখানে তিনি কোন বাধাই দিতেন না, যেখানে তিনি নিয়ম বাঁধিতেন সেখানে তিনি লেশমাছিদ্র রাখিতেন না।

মৃত্যুশোকঃ
              ছোটবেলায়  মাকে হারান কিন্তু সেই শোক তিনি ততটা বুঝে উঠতে পারেন নি। শুধু একটা হাহাকার উঠেছিলযে মা আর কোনদিন ফিরবে না। “যে–বিচ্ছেদের  প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি  প্রাণশক্তির একটা প্রধান অঙ্গ; শিশুকালে এই প্রাণশক্তি নবীন ও প্রবল থাকে, তখন সে কোন আঘাতকে গভীরভাবে গ্রহণ করে না, স্থায়ী রেখায় আঁকিয়া যায় না। ...কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই।



বিলেতঃ 
            ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।  এরপর লন্ডনে এসে  রিজেন্ট পার্কের সামনেএক বাসায় থাকতে সুরু করেন। তারপর ডেভনশায়ারের টার্কি নগরে চলে যান। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি।ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেকসপিয়র ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। অবশেষে ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।  
জীবনবোধঃ  “জীবনস্মৃতি”  তে রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের  নানাদিকেরও পরিচয় পাওয়া যায়। প্রচলিত জীবনাচরণ লেখককে কষ্ট দিয়েছিল তাঁর পরিচয়ও পাওয়া যায়। তাই তিনি বলেছিলেন , ‘ইহার চেয়েও হতেম
যদি আরব বেদুয়িন:
আমাদের দেশের মানুষের জীবনকে বিচিত্রভাবে নিজের জীবনে উপলব্ধি করিবার ব্যথিত আকাঙ্খার কারন হিসেবে বলেছেন, এখানে সমস্তকিছুই বিচ্ছিন্ন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃত্রিম সীমায় আবদ্ধ।পদে পদে নিষেধ আর বাধা।
রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবন মানুষিক এবং সাহিত্যিক পরিণতির ধারাকে বর্ষা এবং  শরতের সাথে বর্ষার  থাকে আড়ম্বর, ঘনঘটা, ভাবাবেগের বাষ্প অন্যদিকে শরতে  থাকে প্রশান্তি



                                                                                                           সমালোচনা


শক্তিশালী দিকঃ   
v  ভাষার সাবলীলতা জীবনস্মৃতি” র সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। সহজ সুন্দরভাবে জীবনের অনেক গভীর দিক তুলে ধরেছেন।  যাহারা নিজে বিশ্বাস নষ্ট করেনা তাহারাই অন্যকে বিশ্বাস করে
v  শিক্ষাপদ্ধতি, শিশুচরিত্র, জীবনের আরো অনেক গভীর বিষয় তিনি সহজভাবে প্রকাশ করেছেন।
        “শিশুচরিত্র নামক পুরান টি সকল পুরানের অপেক্ষা পুরাতন তাহার মত প্রামাণিক শাস্ত্র কোন ভাষায় লিখিত হয় নাই
        “কথার মানে বোঝাটাই মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড় জিনিস নয় শিক্ষা সকলের চেয়ে বড়ো অঙ্গটা বুঝাইয়া দেওয়া নহে, মনের মধ্যে ঘা দেওয়া।‘
       “যাহা সে মুখে বলিতে পারে তাহার চেয়ে  তাহার মনের মধ্যে বাজে অনেক বেশি; যাহারা বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করিয়া কেবল পরীক্ষার দ্বারাই সকল ফল নির্ণয় করতে চান, তাহাঁরা এই জিনিসটার কোন খবর রাখেন না”
v                                                 কৌতুক প্রবণতা বা রসবোধের প্রকাশ
v                                            মাত্র ১৩৬ পৃষ্ঠার একটা বইয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে শৈশব থেকে যৌবনের নানা কথা তুলে ধরেছেন।
v                      অল্প পৃষ্ঠার মধ্যে এত বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা করেছেন, সংগীত (প্রাচ্যা-পাশ্চ্াত্য), চিত্রকলা, সাহিত্যসহ আরও অনেক কিছু বর্ণিত হয়েছে
দুর্বল দিকঃ
“জীবনস্মৃতি” নাম দেখে এটাকে অনেকে রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের নানা ঘটনার বর্ণনা ভাবতে পারে। ক্রম না থাকায় কোন কোন ঘটনা বুঝতে অনেক পাঠক দ্বিধায় পড়তে পারে। কিন্তু এই দ্বিধাও পাঠক মনে আনন্দই জোগাবে।




তুলনামূলক পর্যালোচনাঃ
লেখার ধরনের দিক দিয়ে জীবনস্মৃতি” একটি ব্যতিক্রম আত্মজীবনী। এখানে জীবনের প্রতিটা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা নেই, নেই ঘটনার ক্রমিক বিবরন। বরং লেখকের মনে যেসব ঘটনা দাগ কেটেছে সেইসব দিয়েই তিনি তাঁর স্মৃতিচিত্র এঁকেছেন। “রবীন্দ্র কিশোর জীবনী’’ হায়াত মামুদ অথবা ‘এক ছিল এক রাজকুমার’ খালেদা এদিব চৌধুরীর রবীন্দ্রজীবনী বর্ণিত হয়েছে অন্যের দৃষ্টিতে। লেখকের নিজের দৃষ্টিতে ঘটনাগুলো র ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেন সত্যিকারের রবীন্দ্রনাথের সাথে পথ চলছি। জীবনী গ্রন্থের ধরণ আলোচনা করলে দেখা যায় সেগুলোতে সাধারণত ক্রম অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশের অন্যতম চিন্তাবিদ সরদার ফজলুল করিম এর
আমি সরদার বলছি” (২০১৩) জীবনীমূলক গ্রন্থে তিনি সেই সে কাল কিছু স্মৃতি’, ‘বরিশালের পোলার ঢাকা আগমন’, ‘জীবন জয়ী হবেনামক তিনটি ভাগে বর্ণিত হয়েছে তাঁর জীবনের কাহিনী
“জীবনস্মৃতি” র এর মূল পার্থক্য “আমি সরদার বলছি তে যতটা বিস্তারিত বর্ণনা আছে তাঁর জীবনের নানা কাহিনী কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শুধু স্মৃতিগুলোকে ছুঁয়ে গেছেন সরদারের শৈশব, কৈশোর, যৌথ পরিবারের বেড়ে ওঠা, বরিশাল থেকে রাজধানী ঢাকায় আগমণ , দেশবরণ্যে ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর নানা স্মৃতি আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির কথা, আন্দোলন সংগ্রাম, বন্দিজীবনসহ বৈচিত্র্য- বৈভবে পরিপূর্ণ একটি জীবনের নানা কথা



উপসংহারঃ
জীবনস্মৃতি” পড়ে এক সময় মনে হয়েছে এটা যতটা না জীবনী গ্রন্থ তাঁর চেয়ে বেশি ব্যক্তি হিসেবে এবং সাহিত্যিক হিসেবে পরিণতি লাভের আখ্যান।













No comments:

Post a Comment

জীবনস্মৃতি - রবি ঠাকুর

                                                                                                         জীবনস্মৃতি                       ...